
শন্তির জনপদ সিলেট হঠাৎ করে যেন অশান্ত হয়ে উঠেছে। বেড়েছে হত্যা, ধর্ষণ ও আত্মহত্যার মতো ঘটনা। গেল জুন মাসেই সিলেট বিভাগে ৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। যার বেশিরভাগই ঘটেছে তুচ্ছ কারণে। এর মধ্যে সিলেট জেলায় চারটি ও বাকিগুলো হত্যাকান্ড ঘটেছে বিভিন্ন জেলায়। বাবার হাতে মেয়ে, স্বজনের হাতে স্বজন হত্যার ঘটনাও ঘটছে। সামাজিক অস্থিরতা সেই সঙ্গে পারিবারিক কলহ-বিরোধের জেরে ঘটছে একের পর এক হত্যাকান্ড। এতে করে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বিচারহীনতার কারণে হত্যাকান্ডের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ বেড়েছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকায় অপরাধীরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তুচ্ছ ঘটনায় যাচ্ছে মানুষের জীবন। এ জন্য সামাজিক অবক্ষয়কে দায়ী করছেন তারা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধসহ নানা রকম অস্থিরতার কারণে সম্প্রতি হত্যার ঘটনা বেড়েছ। তবে প্রশাসন হত্যাকান্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে।
সর্বশেষ গত বুধবার (২৫ জুন) বিকেলে সিলেট নগরীর মেজরটিলায় দুই মাসের শিশু ইনায়াকে গলা কেটে হত্যা করেছে পাষণ্ড বাবা। মেয়েকে হত্যার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন তার বাবা আতিকুর রহমান (৪৫)। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
আতিকুর রহমানের বরাত দিয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আতিকুরের জবানবন্দিসহ অন্যান্য তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে শিশুর বাবা তাকে বাথরুমে নিয়ে বটি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করেন। পরবর্তীতে নিজেও গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে আতিকুর রহমান জানিয়েছেন মাথাব্যথার কারণে তার মাথায় হঠাৎ কি যেন হয়েছিল বুঝতে পারেননি।
শিশুরটির মা ঝুমা বেগমের অভিযোগ, এদিন দুপুরের খাওয়া শেষে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, তার স্বামী শিশু সন্তানকে গলা কেটে হত্যার পর তার নিজের গলা কাটছে। তিনি চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে হতাহতদের উদ্ধার করে।
একই দিন সিলেটের জকিগঞ্জে সুজিয়া বেগম সাজন (৩৩) নামের এক গৃহবধূর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি বারহাল ইউনিয়নের মাইজগ্রামের দুবাই প্রবাসী মোখতার হোসেনের স্ত্রী। জানা গেছে, বুধবার ভোরে একটি কক্ষে সুজিয়া বেগমের গলাকাটা অবস্থায় রক্তাক্ত শরীর দেখতে পান তার দেবর ও খালা শাশুড়ি। পরে তারা পুলিশকে খবর দেন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন জানান, পরিবারের লোকজন সুজিয়া বেগমকে মানসিক ভারসাম্যহীন বললেও আসলে তিনি সুস্থ। পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করলে আসল রহস্য উদঘাটন হবে।
এর আগে শুক্রবার হবিগঞ্জের লাখাইয়ে ছাগলের সিমের পাতা খাওয়াকে কেন্দ্র করে চাচাতো ভাইয়ের হামলায় মহিবুর (৩২) নামে এক ব্যাক্তি খুন হয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশ ৩ জনকে আটক করেছে। উপজেলার মুড়িয়াউক গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক মহিবুর গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে।
পরদিন শনিবার সিলেটের শাহপরানের খাদিম পাড়ায় গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই মৃত্যু ঘিরে তদন্ত করেছে পুলিশ। নিহত মনি আকতার (২২) ওই এলাকার একটি বাসায় স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। এ ঘটনায় স্বামী তাজুল ইসলামকে (২৮) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, গলায় উড়না পেঁচানো অবস্থায় ওই গৃহবধূর মরদেহটি ঘরের তীরের সঙ্গে ঝুলে ছিল। ঘরের একটি দরজা ভেতর থেকে লাগানো থাকলেও অন্যটি খোলা ছিল। পুলিশ সন্দেহ করছে, স্বামী তাজুল ইসলাম তাকে হত্যা করে আত্মহত্যার নাটক সাজানোর চেষ্টা করেছেন।
বুধবার সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় সাবিনা বেগম (২৮) নামে এক গৃহবধূক খুন হন। পুলিশ জানিয়েছে, লাশের শরীরে আঘাতের একাধিক চিহ্ন রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই নারীকে হত্যা করে লাশ পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। খুন হওয়া সাবিনা বেগম উপজেলার সুনামপুর গ্রামের আনু মিয়ার (৩৫) স্ত্রী।
মঙ্গলবার (১৭ জুন) হবিগঞ্জের মাধবপুর চাচার হাতে আপন ভাতিজি খুন হয়েছে। উপজেলার ছাতিয়ান ইউনিয়নের এক্তিয়ারপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, ওই গ্রামের বেনু মিয়ার সাথে তার ভাই রেনু মিয়ার জমি নিয়ে বিরোধ চলছিলো। এ নিয়ে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে সুমাইয়াকে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে রেনু মিয়া। উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
শুক্রবার (১৩ জুন) অশালীন আচরনের প্রতিবাদ সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে ভাতিজার হাতে চাচির মৃত্যু হয়েছে। নিহত রুকশানা বেগম (৩৫) উপজেলার দোহালিয়া ইউনিয়নের নিয়ামতপুর গ্রামের মো. ফিরিজ আলীর স্ত্রী।
জানা গেছে, রুকশানা বেগমকে একা পেয়ে অশালীন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে জসীম। এসময় প্রতিবাদ জানালে জসিম উদ্দিন বটি দা দিয়ে রুকশানা বেগমের মাথায় ও শরীরের একাধিক স্থানে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে পালিয়ে যায়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
গত ১২ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় শিক্ষার্থী নাফিয়া জান্নাত আনজুম (১৫) হত্যা করে প্রতিবেশী মো. জুনেল মিয়া। পুলিশ সুপার জানান, গত ১২ জুন সকাল ৭টার দিকে দাউদপুর গ্রামের বাসিন্দা আনজুম পাশের সিংগুর গ্রামে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হয়। এর দুইদিন পর ১৪ জুন বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বাড়ির পাশের ছড়া থেকে ওই স্কুলছাত্রীর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে প্রতিবেশী মো. জুনেল মিয়া আটক করে।জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে পুলিশের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করে জুনেল।
রোববার (১৫ জুন) হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে জমি বিরোধের জেরে দু’পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জাকির হোসেন (৩৮) নামে এক নযুবকের মৃত্যু ঘটে। তিনি পিরোজপুর গ্রামের পল্লী চিকিৎসক হারুনুর রশিদের ছেলে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী দ্য সিলেটকে বলেন, ‘মূলত আত্মনিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েই মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। যেকোনো অপরাধের কার্যকারণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, লাভ-ক্ষতির হিসাব বিবেচনায় নিয়ে মানুষ অপরাধ করে থাকে। যখন দেখে অপরাধ করার ফলে ক্ষতির তুলনায় লাভ বেশি, সে ক্ষেত্রে অপরাধের ঝোঁকও বাড়ে অপরাধীদের মধ্যে। নানা পারিপার্শ্বিকতার কারণে মানুষ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় উগ্র।’
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমশিনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এসব ঘটনার বেশিরভাগই ‘ঠুনকো বিষয়ে ঝগড়া ও সম্পত্তির দ্বন্দ্ধ থেকে ঘটছে। পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধসহ নানা রকম অস্থিরতার কারণে সম্প্রতি হত্যার ঘটনা বেড়েছ। তবে প্রশাসন হত্যাকান্ড জড়িতদের গ্রেপ্তার ও রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে।’