এক বছরে ট্রাকচাপায় নিহত ১০
জৈষ্ঠ প্রতিবেদক || দ্য সিলেট টোয়েন্টিফোরডটকম

সিলেট যেন ট্রাকের শহর। নগরীর যেখানে তাকানো যায়, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে পাথরবাহী অথবা পণ্যবাহী ট্রাক। দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন রশিদ স্কয়ার, চন্ডীপুল কিংবা কদমতলী নয়, পুরো নগরই এখন ট্রাক স্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে। খালি জায়গা পেলেই ট্রাক পার্ক করছেন চালকরা। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট, বাড়ছে জনদুর্ভোগ। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়, এই ট্রাকগুলোর চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে প্রায়শই প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ পথচারী ও যানবাহন চালকরা।
নগরবাসীর অভিযোগ, সড়কের ট্রাক থেকে নির্দিষ্ট হারে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। অথচ প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন কার্যত নিষ্ক্রিয়। এতে করে নাগরিক নিরাপত্তা, চলাচল এবং শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে।
সবশেষ গত ১৯ এপ্রিল নগরীর চৌহাট্টা এলাকায় ট্রাকচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী মো. শহিদ আহমদ চৌধুরী ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। একইভাবে দক্ষিণ সুরমার চন্ডীপুল এলাকায় ইমতিয়াজ মাহবুব মির্জা (২০) নামের এক তরুণের প্রাণ যায় ট্রাকের ধাক্কায়। আম্বরখানায় প্রাণ হারান রঙ্গিটিলার যুবক ইমরান আহমেদ ডালি (২২)। আখালিয়ায় আরেকজন অজ্ঞাতনামা বৃদ্ধ এবং সুবিদবাজারে শাবিপ্রবির ছাত্র সাব্বির আহমেদের মৃত্যুও ঘটে ট্রাকচাপায়।
সাব্বির আহমেদের মৃত্যু গভীর ক্ষোভ ও প্রতিবাদের জন্ম দেয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা নগরীর অভ্যন্তরে ট্রাক চলাচল বন্ধসহ ছয় দফা দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেন।
শহরের ভেতর দিয়ে ট্রাক চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে এর আগেও সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর মধ্যে ছিল ভোলাগঞ্জ থেকে পাথরবাহী ট্রাকগুলোকে বাইপাস সড়ক দিয়ে চালানোর ব্যবস্থা এবং নগরীর বাইরে আধুনিক ট্রাক টার্মিনাল স্থাপন। সে লক্ষ্যে দক্ষিণ সুরমার পারাইরচকে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় সিলেট কেন্দ্রীয় ট্রাক টার্মিনাল। তবে নির্মাণের পাঁচ বছর পরও সেই টার্মিনাল কার্যত অচল হয়ে পড়ে আছে। ট্রাকচালকরা সেখানে যান না, যান নগরীর মধ্যেই।
সচেতন মহল বলছেন, ট্রাক চলাচল একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতা, কিন্তু তা যেনো কোনো শহরের প্রাণহানির কারণ না হয়। তারা বলছেন, “ব্যর্থতার কথা আর শুনতে চাই না, চাই দৃশ্যমান ও কার্যকর পদক্ষেপ।”
এ বিষয়ে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম বলেন, “ট্রাক নগরবাসীর জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা একাধিকবার সংশ্লিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেছি। শহরের ভেতর দিয়ে ট্রাক যাতে চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত করা যায় সে বিষয়ে কিছু পরিকল্পনাও দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কিছুই আমলে নেওয়া হয়নি।”
সড়কের ভেতর দিয়ে দেদারছে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটে সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, “নগরবাসীর যন্ত্রণার আরেক কারণ এই পণ্যবাহী ট্রাক। নগরীতে ট্রাক প্রবেশের জন্য মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে একটি সময় বেধেঁ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু ট্রাক চলকেরা সেটিও মানছে না। যখন-তখন নগরীতে ট্রাক প্রবেশ করছে। যেকারণে প্রাণহানির মতো ঘটনাগুলোও ঘটছে। পুলিশ যদি নগরীতে ট্রাক প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ না করে তাহলে দুর্ঘটনা রোধ করাটাও বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।”
সিলেট জেলা ট্রাক পিকআপ কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জিলু মিয়া বলেন, “ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক থেকে টার্মিনালের দূরত্ব বেশি। তাছাড়া ভেতরে খবারের হোটেল, ওয়ার্কশপ, মসজিদসহ কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। যে কারণে চালকরা টার্মিনালে আসতে আগ্রহ হারাচ্ছে।”
এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমরা নিয়মিত প্রচারণা চালাচ্ছি। কিছুদিন পরপর ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করা হচ্ছে। এছাড়া নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে।”
তিনি আরো বলেন, “পণ্যবাহী ট্রাকগুলোর টার্মিনালে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ তারা মালামাল নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। এছাড়া সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নগরীতে ট্রাক প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেজন্য ট্রাকগুলো প্রবেশমুখে এ সময়টাতে দাঁড়িয়ে থাকে।”